মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে অভিবাসন খাতে আগেও ১০টি সিন্ডিকেট ছিল। সে সময় এসব সিন্ডিকেট বন্ধ করেছিল মালয়শিয়ার সরকার। সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানো ব্যয়বহুল হওয়ার পাশাপাশি শ্রমবাজার খুলতে অনেক সময় লেগে যাবে। ফলে এই সিন্ডিকেট ভেঙে দেশটিতে যেন সব এজেন্সিই শ্রমিক পাঠাতে পারে সেই দাবি জোরালো হয়েছে।

রাজধানীর বনানীতে হোটেল শেরাটনে এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এই অভিমত তুলে ধরেন। বায়রা সিন্ডিকেটবিরোধী মহাজোট গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। বৈঠকের আলোচ্য বিষয় ছিল মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে কোনো প্রকার সিন্ডিকেটকে অনুমোদন না দিয়ে বাংলাদেশের কম্পিটিশন আইন অনুযায়ী এবং মালয়েশিয়ায় অন্যান্য শ্রমিক প্রেরণকারী ১৩টি সোর্স কান্ট্রির ন্যায় বাংলাদেশের সকল বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির জন্য শ্রমবাজার উন্মুক্তকরণ। প্রায় পাঁচ মাস আগে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে মালয়েশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই (এমওইউ) হয়। তবে এত দিনেও দেশটিতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। পুরো প্রক্রিয়াই থমকে আছে। বাংলাদেশি ২৫ রিক্রুটিং এজেন্সি সিন্ডিকেটের অপতৎপরতার কারণেই মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার আটকে আছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

‘মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খুলতে বাধা দিচ্ছে রিক্রুটিং এজেন্সি’

গোলটেবিলে প্রধান অতিথির হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। দেশের জনগণই প্রধান চালিকাশক্তি মন্তব্য করে আনিসুল ইসলাম বলেন, ‘এই শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। বিশ্ব অর্থনীতির এই মন্দার সময় বিদেশের শ্রমবাজার আমাদের অন্যতম শক্তির জায়গা। স্বল্প ব্যয়, ন্যায্য মজুরি ও নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে সিস্টেম পরিবর্তন করতে হবে।’ ২৫ জনের সিন্ডিকেট দিয়ে দেশের কোনো লাভ নেই বলে মনে করেন ইউনিক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও বায়রার সাবেক সভাপতি মোহা. নূর আলী। বিদেশ যেতে কাউকে যেন বাড়িঘর বিক্রি বা ব্যাংক ঋণ নিতে না হয়- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন তাগিদও বক্তব্যে তুলে ধরেন নূর আলী।

তিনি বলেন, ‘সিন্ডিকেট যদি ভালো মাধ্যম হলে তা হতে পারে। কিন্তু এই সিন্ডিকেট দেশের জন্য লাভ না লোকসানের সেটি আমাদের সরকারকে হিসাব করতে হবে। আমি এই বিষয়ে সরকারকে চিন্তা করতে বলব—এই সিন্ডিকেট দেশের কোনো স্বার্থ বয়ে আনবে কি না।’ সিন্ডিকেট দিয়ে শ্রমবাজার খাতের কোনো লাভ নেই মন্তব্য করে কেন লাভ নেই তার ব্যাখ্যাও দেন বায়রার এই সাবেক সভাপতি। বলেন, ‘সিন্ডিকেট হলেই খরচ বেড়ে যাবে। একজন শ্রমিক সিন্ডিকেটকে যে টাকা দিয়ে মালয়েশিয়া যাবেন, সেই টাকা তুলতে তার দুই বছর সময় লেগে যাবে। সুতরাং শ্রমিক পাঠাতে আমাদের যে খরচ, সেটা আরও বেড়ে যাবে। যেহেতু বেড়ে যাবে, সেহেতু এই সিন্ডিকেট দরকার নেই।’

কর্মী পাঠাতে মালয়েশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি সম্পন্ন

২৫ জনের ওই সিন্ডিকেট দিয়ে ১৫ থেকে ২০ লাখ শ্রমিক পাঠানো সম্ভব নয় বলেও জানান নূর আলী। এছাড়া ওই সিন্ডিকেটের বেশিরভাগেরই শ্রমিক পাঠানোর অভিজ্ঞতা নেই বলেও জানান তিনি। তাহলে তারা কীভাবে লোক পাঠাবে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, এই সিন্ডিকেট কার স্বার্থে? দেশের স্বার্থে? নাকি একজন ব্যক্তি স্বার্থে, যার অডিও রেকর্ড সামনে আসছে। এই লোকের স্বার্থে আমরা কি কাজ করব, নাকি দেশের স্বার্থে কাজ করব? সুতরাং এখানে ১৫ থেকে ২০ লাখ লোক পাঠাতে হলে কোনোভাবে এদের দ্বারা পাঠানো সম্ভব নয়।’

সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ভালো কিছু হয় না বলে মনে করেন দেশের ব্যভসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি একে আজাদ। তিনি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর বিষয়ে একমত জানিয়ে বলেন, ‘যাতে এই সিন্ডিকেটের বাইরে গিয়ে সবাই উন্মুক্তভাবে প্রতিযোগিতামূলকভাবে বিদেশে শ্রমিক পাঠাতে পারি। দেশের জনশক্তি খাত নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে নানা ষড়যন্ত্র চলছে মন্তব্য করে বায়রার সাবেক মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘এই খাত ধ্বংস হয়ে গেলে দেশের জন্য কল্যাণ হবে না। শ্রমিকদের স্বার্থে অভিবাসন খাতে যারা কাজ করি তাদের স্বার্থে একটি অভিন্ন নীতি থাকা প্রয়োজন। অথচ কোটা ব্যবস্থা তৈরি করে এই খাত ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। যারা এই কাজ করছে তারা দেশের কল্যাণে কাজ করছে না।’

শ্রমবাজার খুলতে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করতে মালয়েশিয়ায় যাচ্ছেন মন্ত্রী

মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মীর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে এবং তা কেন সেই ব্যাখ্যা দিয়ে বায়রার সদ্য বিদায়ী কমিটির মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের অবস্থান মর্যাদাপূর্ণ অভিবাসনের প্রতি, সেই জন্য আমাদের সরকারের আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু যেকথা বলা হচ্ছে, মালয়েশিয়ার শ্রমিক পাঠাতে এই ২৫ এজেন্সির সিন্ডিকেট চালু না করলে বাজার হারানোর শঙ্কা আছে।’

‘সত্য হচ্ছে, মালয়েশিয়ায়েএখন কোনো দেশ থেকে কর্মী যাচ্ছে না। যেকারণে বাংলাদেশি কর্মী ছাড়া তাদের সামনে পথ নেই। কিন্তু দুঃখজনকভাবে কিছু মানুষ নিজের স্বার্থ হাসিলে এই শ্রমবাজার নষ্ট করছে। আমি বিশ্বাস করি, এই চক্র যেন শ্রমবাজার ধ্বংস করতে না পারে সেজন্য সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে’—যোগ করেন শামীম আহমেদ। গোলটেবিলে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাংবাদিক ও অভিবাসন বিশেষজ্ঞ শরিফুল হাসান। আলোচনায় অন্যদের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন অভিবাসন ও উন্নয়নবিষয়ক সংসদীয় ককাসের নির্বাহী কমিটির সভাপতি ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী, ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত, সেন্টার ফর এনআরবির চেয়ারপারসন এমএস সেকিল চৌধুরী, বায়রার সাবেক সভাপতি আবুল বাসার, বায়রার সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা, রিয়াজুল ইসলাম প্রমুখ।

ব্যারিস্টার শামীম হায়দার বলেন, ‘বায়রা শক্তিশালী নয়, এটি আমাদের বড় ব্যর্থতা। বায়রা প্রচুর মানুষ বিদেশে পাঠিয়েছে, দেশের চালিকাশক্তিতে অবদান রেখেছে। কিন্তু নিজেদের সংগঠনের মধ্যে ঐক্যমত্য আনতে পারেনি। এখন সময় এই উপলব্ধিটা করার।’ শরিফুল হাসান তার মূল প্রবন্ধে বলেন, ‘আমরা আশাবাদী হলাম যখন ২০২১ সালের ডিসেম্বরে আবার চুক্তি হলো মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, ঘুরেফিরে আবার সেই সিন্ডিকেটের আলোচনা। মালয়েশিয়ার একজন মন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে চিঠি দিয়ে বললেন, ২৫টি রিক্রুটিং এজেন্সির বাইরে লোক নেব না। এটা একটা অদ্ভুত ঘটনা।’

‘মালয়েশিয়া অন্যান্য দেশ থেকে যেভাবে কর্মী নেয় তার সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়ার পুরো প্রক্রিয়া আলাদা। শুধু মালয়েশিয়া নয়, আমাদের পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ করতে প্রযুক্তিবান্ধব পদ্ধতি গড়ে তুলতে হবে।’

বাংলাদেশের সব বৈধ লাইসেন্সধারী এজেন্সিকে একটি ডিজিটাল প্লাটফর্মে নিয়ে আসার পরামর্শ দিয়ে এই অভিবাসন বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘এমন একটা পদ্ধতি থাকতে হবে, যেন যে কোনো বিদেশি নিয়োগকর্তা বাংলাদেশের সব বৈধ লাইসেন্সধারী রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে তাদের চাহিদা অনুযায়ী কর্মী সংগ্রহ করতে পারেন।’